বাঁশখালীতে হত্যা, হামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন বন্ধের দাবিতে ৬৩ নাগরিকের বিবৃতি

২৯ মে ২০২১, শনিবার 
-------------------------

বাঁশখালীর বিতর্কিত কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বার্থ রক্ষা করতে ২০১৬, ২০১৭ ও সর্বশেষ ২০২১-এর ১৭ এপ্রিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় অন্তত ১২ জন নিরীহ শ্রমিক ও গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন, এবং গুরুতর আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। নিহত ১২ জনের ৬ জনই গণ্ডামারার অধিবাসী। যেখানে সকল মহল থেকে এসব গুলিবর্ষণের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি প্রদান করার দাবি উঠেছে সেখানে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সরকার বরং ভুক্তভোগীসহ সকলের কথা বলার অধিকারের সংকোচন করছে নানাভাবে। সর্বশেষ গত ২৭ মে ২০২১ (বৃহস্পতিবার) রাতে কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে বাঁশখালী পুলিশ গণ্ডামারা থেকে প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে। এর ফলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কোন অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কেউ ভবিষ্যতে কথা বলার সাহস পাবে না। 

গত ২৭ মে ২০২১, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিফ কোঅর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারার আওতায় ”আক্রমণাত্মক মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে বিদ্বেষ, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির” মিথ্যা অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৪৭/১৭৩। মামলার এজাহার অনুসারে, গত ২৬ মে ২০২১ বিকাল ৩:০০টায় গণ্ডামারার অধিবাসী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ আহমেদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন : “ব্রেকিং নিউজ : টুয়েল্ভ মার্ডারের (১২ খুনের) পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বাঁশখালীর মানুষ মনে করেছিল, গন্ডামারা ইউনিয়ন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। আজ দেশের মানুষ প্রকৃতপক্ষে দেখতে পাচ্ছে, গণ্ডামারাবাসী জোয়ারের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাঁশখালীর তরুণ ও যুবসমাজকে সাহসী লেখনীর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং উন্নয়নের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে নির্ভয়ে।” 

এই পোস্টের মাধ্যমে শাহনেওয়াজ আহমেদ প্রকল্পের বিষয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং যুবসমাজকে লেখনির মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যা কোনভাবেই আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা মনে হওয়ার যুক্তিসংগত কোন কারণ নেই। আমরা মনে করি যে, জোরপূর্বক ভিন্নমত দমনের উদ্দেশ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলোর অধীনে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তার দায়ের করা ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষমূলক মামলায় বাঁশখালী থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। 

উল্লেখ্য যে, গত ৪ মে ২০২১ মহামান্য হাইকোর্ট নিহতদের প্রত্যেককে আপাতত ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত শ্রমিক, শ্রমিকদের পরিবার ও এলাকাবাসীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়ার এবং তাঁদেরকে কোন প্রকার হয়রানি না করার আদেশ দেন। এই মামলা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। 

আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসী-শ্রমিকদের নিহত-আহত হবার ঘটনায় কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত ও কার্যকরী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ হয়নি বরং ৩,৫৬২ জন নিরস্ত্র শ্রমিক ও এলাকাবাসীকে আসামী করে প্রকল্প উদ্যোক্তা ও পুলিশ মামলা দায়ের করেছে যা অব্যাহত হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি করছে। এছাড়া প্রশাসনের বৈরীতার কারণে ২০১৬ সালে নিহতদের পক্ষে দায়েরকৃত দুটি মামলা জেলা জজ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। 

উপরন্তু, পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির ১৯ মে ২০২১ দাখিলকৃত প্রতিবেদনে গুলি করে হত্যার জন্য প্রকল্প উদ্যোক্তার অব্যবস্থাপনা ও বেআইনি কার্যক্রমের বিষয়ে কিছু উল্লেখ বা দায়ী পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত ও শাস্তির সুপারিশ না করে অযথা গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে ভাষাগত দূরত্ব, চীনা শ্রমিকদের হুমকি প্রদান, ঠিকাদারদের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় চরম অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনা হয়েছে। আমরা এ ধরনের দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি এবং বাঁশখালীতে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এর উদ্যোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে সকল প্রকার হামলা, হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধে এবং এর জন্য দায়ী সকলের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাচ্ছি। 

বাঁশখালীর জনগণের জীবন-জীবিকা-সম্পদ ও পরিবেশের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমরা দাবি জানাচ্ছি যে,  
  1. মহামান্য আদালতের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ আহমেদের নামে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও তাঁকে মুক্তি দিতে হবে; 
  2. নিপীড়নমূলক ও সংবিধান-বিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে; 
  3. ১৭ এপ্রিল গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; 
  4. বাঁশখালীতে নিহতদের পক্ষে মামলা দায়ের করতে হবে। 
  5. পরিবেশ-বিধ্বংসী বাঁশখালী কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করতে হবে এবং বিনিয়োগকারী কোম্পানির অব্যবস্থাপনা ও বেআইনি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
  6. নিহত ও আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

স্বাক্ষরকারী 

  1. অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা 
  2. ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র 
  3. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি 
  4. ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও চেয়ারপারসন, ব্র্যাক 
  5. বদিউল আলম মজুুমদার, সদস্য সচিব, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) 
  6. অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  7. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) 
  8. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) 
  9. ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী 
  10. ফারাহ কবীর, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ 
  11. শিরীন পারভীন হক, নারী অধিকার কর্মী 
  12. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্মস্ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) 
  13. ড. সিআর আবরার, প্রাক্তন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
  14. রেহনুমা আহমেদ, লেখক 
  15. জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট 
  16. তানজিম উদ্দিন খান, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
  17. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
  18. জাকির হোসেন, নাগরিক উদ্যোগ 
  19. ওমর তারেক চৌধুরী, লেখক ও অনুবাদক 
  20. সুব্রত চৌধুরী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট 
  21. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
  22. ড. নাসরিন খন্দকার, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  23. মাইদুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় 
  24. ড. সাদাফ নূর, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 
  25. অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  26. গৌরাঙ্গ নন্দী, সাংবাদিক 
  27. ড. কাজী জাহেদ ইকবাল, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট 
  28. অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  29. ড. সামিনা লুৎফা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
  30. শরীফ জামিল, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) 
  31. রেজাউর রহমান লেনিন, গবেষক 
  32. ড. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক 
  33. সায়েমা খাতুন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
  34. আহমেদ স্বপন মাহমুদ, নির্বাহী পরিচালক, ভয়েস 
  35. মনোয়ার মোস্তফা, নির্বাহী পরিচালক, ডেভেলপমেন্ট সিনার্জি ইনস্টিটিউট 
  36. এস.এম. নাজের হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, আইএসডিই-বাংলাদেশ 
  37. শমশের আলী, সদস্য, প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চ 
  38. জাকির হোসেন খান, নির্বাহী পরিচালক, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ 
  39. আনোয়ার হোসেন, গ্রিনফিল্ড লাইলভলিহুড অ্যান্ড সার্ভিসেস (জিএলএস) 
  40. অরূপ রাহী, সঙ্গীত শিল্পী ও লেখক 
  41. ড. মাহা মির্জা, গবেষক 
  42. শামসুদ্দোহা, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) 
  43. নূর আলম শেখ, সদস্য সচিব, মংলা নাগরিক সমাজ 
  44. আমিনুজ্জামান মিলন, নির্বাহী পরিচালক, বন্ধন 
  45. নুরুল আলম মাসুদ, সাধারণ সম্পাদক, খানি-বাংলাদেশ 
  46. আব্দুল্লাহ আল নোমান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট 
  47. বরকতউল্লাহ মারুফ, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী 
  48. সেকেন্দার আলী মিনা, নির্বাহী পরিচালক, সেইফটি অ্যান্ড রাইটস্ সোসাইটি (এসআরএস) 
  49. সোহেইল জাফর, সম্পাদক, উন্মোচন ডটকম 
  50. এস.এম. তৌহিদুল ইসলাম শাহাজাদা, নির্বাহী পরিচালক, প্রান্তজন 
  51. রাশেদ রিপন, পরিচালক, পরিবর্তন-রাজশাহী 
  52. সোহানুর রহমান সোহান, সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস 
  53. রোজিনা বেগম, গবেষক 
  54. হানা শামস, গবেষক 
  55. ফারজানা আক্তার নিবেদিতা, গবেষক 
  56. জান্নাতুল মাওয়া, আলোকচিত্রী 
  57. বীথি ঘোষ, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক 
  58. অমল আকাশ, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক 
  59. টেংকু মেহেদী, সংস্কৃতিকর্মী 
  60. মুনেম ওয়াসিফ, আলোকচিত্রী 
  61. ঋতু সাত্তার, নাট্যকর্মী 
  62. মাহবুব আলম প্রিন্স, উন্নয়নকর্মী 
  63. হাসান মেহেদী, সদস্য সচিব, বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোট (বিডাব্লিউজিইডি)