সংবাদ বিজ্ঞপ্তি । ৭ জুন ২০২২
------------------------------------
আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ২৫ বছর মেয়াদে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিশেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা (১১.০১ বিলিয়ন ডলার) নিবে - সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশি নাগরিক সমাজের জোট বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোট (বিডাব্লিউজিইডি) ও ভারতীয় গ্রোথওয়াচ কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো জানানো হয় যে, ক্যাপাসিটি চার্জের এ অর্থ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
এ সম্পর্কে প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও বিডাব্লিউজিইডি’র সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ”যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে তার পরিমাণ কর্ণফুলি টানেলের মোট বাজেটের নয়গুণ এবং ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্পের চারগুণেরও বেশি”।
প্রতিবেদন অনুসারে আদানি গ্রুপ প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা (৪২৩.২৯ মিলিয়ন ডলার) ক্যাপাসিটি চার্জ হিশেবে গ্রহণ করবে যা বাংলাদেশের জনগণের উপকার না করে বরং আদানি গ্রুপকে আরো ধনী হবার সুযোগ করে দেবে।
হালনাগাদকৃত অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগামী আগস্ট মাসে উৎপাদন শুরু করবে যদিও সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েই আদানি গ্রুপকে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
প্রতিবেদনের প্রাক্কলন অনুযায়ী, আদানি পাওয়ারের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে কমপক্ষে ৯ টাকা ৯ পয়সা যা বিদ্যমান আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্যের তুলনায় ৫৬ শতাংশ ও ভারতের সৌরবিদ্যুতের তুলনায় ১৯৬ শতাংশ বেশি।
এছাড়া, আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। অন্যদিকে দেশে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে।
হাসান মেহেদী বলেন, ”এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক চাপ তৈরি করবে। বাংলাদেশের অতি-সক্ষমতার মাত্রা ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবার পর ভারত থেকে অতি-খরুচে বিদ্যুৎ আমদানির কোনো যৌক্তিকতা নেই”।
প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী, গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ক্ষতিকর বায়ুদুষণ ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির (স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও মৎস্য) পরিমাণ বছরে ৫ হাজার ৫৬৯ কোটি ভারতীয় রুপি (৭২৯.৬৪ মিলিয়ন ডলার) ও ২৫ বছরের মেয়াদে কমপক্ষে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭০৮ কোটি ভারতীয় রুপির (২৪.৭২ বিলিয়ন ডলার) সমান।
আদানি পাওয়ার পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না।
আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ-বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ২০১৭ সালের নভেম্বরে আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি (পিপিএ) সম্পাদন করে। এ পিপিএ অনুসারে বিউবো প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিপরীতে আদানি গ্রুপকে ৩ টাকা ২৬ পয়সা (০.০৩৮ ডলার) ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ায় সম্মত হয় যা বাংলাদেশের অন্য যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।
চুক্তি সম্পাদনের পর, আদানি গ্রুপ ঝাড়খণ্ডের স্থানীয় অধিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ১ হাজার ২৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এছাড়া কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ ও অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি বছর ৯৩.৫ লাখ টন কার্বন নির্গমন হবে যা ২৫ বছরের মেয়াদকালে ২২ কোটি ১১ লাখ টনে পৌঁছে যেতে পারে। ভারত বর্তমানে বায়ুদুষণের দিক দিয়ে পৃথিবীর পঞ্চম ও কার্বন নির্গমনের দিক দিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র দুষণ ও নির্গমনের দিক দিয়ে ভারতের অবস্থানকে আরো দুর্বল করবে।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত গ্লাসগো সম্মেলনে ভারত ২০৫০-এর বদলে ২০৭০ সালে গড়শূন্য নির্গমনের ঘোষণা দিলে সারা পৃথিবী থেকে এ অবস্থানের সমালোচনা করা হয়। আদানি পাওয়ারের গড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতকে ‘জলবায়ু বিরোধী’ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
যেহেতু বাংলাদেশ সরকার এককভাবে এ চুক্তি বাতিল করতে পারে না সেহেতু প্যারিস চুক্তি ও গ্লাসগো প্রতিশ্রুতির আলোকে বর্তমান চুক্তি সংশোধন করে ভারত থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যে প্রতিবেদনটিতে একটি যৌথ কমিটি গঠন করার জন্য উভয় সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়।
গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ বিধান আরোপ এবং যে কোনো পণ্য বা পরিষেবা আমদানির ক্ষেত্রে কার্বন নির্গমন ও মানবাধিকারের মানমাত্রা আরোপের সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও গ্রোথওয়াচের সমন্বয়কারী বিদ্যা দিনকর বলেন, ”মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অনুসারে ভারত বা অন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ করে শুধুমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি আমদানির জন্য বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থান নেয়া উচিৎ”।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার আওতায় আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সরবরাহের জন্য আদানি গ্রুপকে বাধ্য করার জন্য নির্দেশ দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিডাব্লিউজিইডি’র আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের চুক্তি বাতিল করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।”