ঢাকা; ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
-------------------------------------------------
১. মূখবন্ধ (Preamble)
সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য
করা যাচ্ছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির পারস্পরিক অভিঘাত বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক
ও জাতীয় অর্থনীতি এবং জনসমাজের উপর বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে
চলেছে। বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির প্রবাহ উন্নয়নশীল ও
স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে
দিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে পুঁজির গতিমুখেরও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা
যাচ্ছে। পুঁজির প্রবাহ অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় আরো বেশি মাত্রায় পশ্চিম
থেকে পূর্বমুখী হয়েছে। সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতুলতা, দুর্বল
সরকার-ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে এশীয়
উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো এখন আন্তর্জাতিক পুঁজি বিনিয়োগের আকর্ষণীয়
ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অর্থায়ন প্রক্রিয়া ও কাঠামোতে সূচিত হয়েছে
বড় ধরনের পরিবর্তন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইফাদ, ইসলামি উন্নয়ন
ব্যাংকসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্রিকস-এর
নেতৃত্বে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক
(এআইআইবি) কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের সরকারগুলোও ইতিমধ্যে কল্যাণমূলক
রাষ্ট্রের ধারণা ত্যাগ করে নানা মাত্রায় ‘নয়া-উদারবাদি অর্থনীতি’র
কৌশলসমূহ গ্রহণ করে নিয়েছে। পণ্য ও পুঁজির মুক্তপ্রবাহ তথা
‘মুক্ত-বাজারব্যবস্থা’কেই উন্নয়ন-অগ্রগমনের মূলনীতি হিশেবে গ্রহণ করা
হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মসূচিতে প্রতিনিয়তই তার প্রতিফলন ঘটছে। ফলে,
পুজি ও মুনাফার স্বার্থে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, শ্রম-পরিবেশ ও
মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
অথচ জাতিসঙ্ঘ সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ; আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক অধিকার চুক্তি; আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি;
জাতিসঙ্ঘ প্রাণবৈচিত্র্য সনদ; জাতিসঙ্ঘ আদিবাসী অধিকারের ঘোষণাপত্রসহ
সর্বসম্মত সনদ ও ঘোষণাসমূহে সার্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি
ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রসমূহ এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নানা মাত্রায়
অঙ্গীকারাবদ্ধ। অন্যদিকে ইতোমধ্যেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
(এমডিজি)’র মেয়াদ শেষ হবার পর আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের
ভবিষ্যত প্রভাব মোকাবেলায় গ্রহণ করা হয়েছে প্যারিস চুক্তি যা জলবায়ু
অভিযোজন ও প্রশমনে অর্থায়নসহ অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করবে বলে
আশা করা হচ্ছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সারা পৃথিবীব্যাপী
এখন অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন-এর ধারণা ও চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা
হচ্ছে।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি যে, নয়া উদারবাদি ব্যবস্থায় আয় ও সম্পদের অসমতা
আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের, এমনকি একই দেশ ও
সমাজের মধ্যে এক গোষ্ঠীর সাথে আরেক গোষ্ঠীর মধ্যকার অসমতা উন্নয়ন অগ্রগমনের
পথে মারত্মক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এসব দেশের সরকারসমূহ
জিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাছ-বিচারহীনভাবে দানবীয়
অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করে চলেছে। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণদানকারী
প্রতিষ্ঠানসমূহ এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করে চলেছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবকা এসব দানবীয় প্রকল্পের ভারে চাপা
পড়ে যাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্ররিবেশ-প্রতিবেশ, লঙ্ঘিত হচ্ছে সম্পদের
ওপরে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী অধিকার। লক্ষণীয় যে, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বহুপাক্ষিক
ঋণদানকারী সংস্থাগুলোও তাদের নিজেদের রচিত স্ব স্ব রক্ষাকবচ-এর ধারণা ও
চর্চা থেকে পিছু হটে এই দায়িত্ব সরকারসমূহের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যত,
পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য পুঁজির মালিকরা কোনো দায়িত্ব নিতে
চাইছে না। এটা এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বৈ কিছু নয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে নাগরিকদের জীবন,
সম্পদ ও সম্মানের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে
বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য সুস্থ পরিবেশ সংরক্ষণে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ।
এছাড়া জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদ ও প্রাণবৈচিত্র্য সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে
বাংলাদেশ মৌলিক মানবাধিকার ও পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত
করেছে। ইতোমধ্যেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের হিসেবে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের
দেশ হিশেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং প্রবৃদ্ধির গতিধারায় পূর্ণ মধ্যম আয়ের
দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা (রূপকল্প ২০২১) ও
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জাতীয় নীতি ও কৌশলপত্রে
এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিন্তু ঢালাওভাবে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচির নামে গৃহীত কার্যক্রমের
মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবার নজির রয়েছে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের
মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে ফেলেছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গ্যাসক্ষেত্র
দুর্ঘটনায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। অথচ পরিবেশ ধ্বংসকারী বহুজাতিক
কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেও কোন ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। দেশের
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিবছর দশ লক্ষাধিক মানুষ জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত
হচ্ছে। বাংলাদেশের একমাত্র বাদাবন ও ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য স্থান
সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয় অবধারিত জেনেও সেখানে কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদন
কেন্দ্র বন্ধ করতে সরকার রাজি নয়। এই ভয়াবহ পরিবশেবিধ্বংসী প্রকল্পের
বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ-সংগ্রামও নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে। উন্নয়নের
নামে বিদেশী পুঁজির অবাধ বিচরণ ও লুন্ঠনের পথ প্রশস্ত করাই এখন রাষ্ট্রের
অন্যতম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাড়তি হুমকি হিশেবে দেখা
দিয়েছে। অপরিণামদর্শী ও জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলোর
নেতিবাচক প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। টেকসই
উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য পথে এগুলো প্রধানতম বাধা হিশেবে
হাজির হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ),
অভিযোজন তহবিল (এএফ) ও দ্বিপাক্ষিক অর্থায়নের পাশাপাশি বহুজাতিক আর্থিক
প্রতিষ্ঠানগুলোও নানাবিধ তহবিল গঠন করেছে। এসব তহবিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর
জাতীয় অগ্রাধিকারের গুরুত্ব দেয়া তো হচ্ছেই না বরং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবহার
করে ঋণবাণিজ্য সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা গণতন্ত্রের অন্যতম দুটি স্তম্ভ। উন্নয়ন প্রকল্প ও
কর্মসূচি গ্রহণে জনঅংশগ্রহণ না থাকার কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পথ
ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। দেশে বিদ্যমান ‘কাগুজে গণতন্ত্র’-এর ধারা ও চর্চা
উন্নয়ন বিতর্কের জন্য প্রয়োজনীয় জনপরিসর (public space) সংকুচিত করে
দিয়েছে। নাগরিক সমাজ ও ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর বাদ-প্রতিবাদকেও
ভয়-ভীতি-দমন-পীড়নের মাধ্যমে নির্জীব করে ফেলা হচ্ছে। ফলে টেকসই ও
অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টতই একটি কাগুজে প্রতিশ্রুতিতে
পরিণত হয়েছে। আমরা মনে করি, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য
পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভূমি, পানি, বন-জঙ্গল, জলাশয়, খনিজসম্পদ, কৃষি, খাদ্য ও
মাৎস্যসম্পদ সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান যেসব আইন ও নীতি রয়েছে
সেগুলির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দরকার। অন্যদিকে যেসব আইন ও নীতি সাধারণ
মানুষের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না, সেগুলির পুনর্বিবেচনা দরকার; প্রয়োজনে
নতুন নীতি-আইন তৈরি করে একটি স্বমন্বিত ‘রক্ষাকবচ কাঠামো’ তৈরি করা দরকার।
একই সাথে আমরা দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব
‘রক্ষাকবচ কাঠোমো’র উপস্থিতি ও বাস্তবায়নও দেখতে চাই।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একটি সু-স্বমন্বিত রক্ষাকবচ কাঠামো ও এর
পরিপূর্ণ বাস্তবায়নই উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচির নেতিবাচক প্রভাব থেকে
সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে পারে। বিশেষত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল
জনগোষ্ঠী যেমন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উৎপাদক, জেলে, বনজীবী, শ্রমজীবী,
আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও নারীদের জন্য বিশেষ রক্ষাকবচ
প্রয়োজন। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করার জন্য এসব নীতি
ও আইন আধুনিকায়ন এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি,
ধ্বংসাত্মক উন্নয়নের ক্ষতি থেকে সম্পদের ওপর মানুষের ব্যক্তি ও যৌথ
অধিকার, ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার জন্য স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও
আন্তর্জাতিক পরিসরে জনগণের কণ্ঠস্বরকে প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তর এবং আরো
বেশি উচ্চকিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নাগরিক সমাজ ও ভূক্তভোগী জনগোষ্ঠীর
মধ্যে পারস্পরিক সংহতি, সংগঠন ও যৌথ প্রতিবাদি কন্ঠই কেবল পুঁজির আগ্রাসী
থাবা থেকে মানব-প্রজাতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও মানুষের সমাজকে টিকিয়ে রাখতে
সক্ষম।
২. রক্ষাকবচের মান (Standard of Safeguards)
উন্নয়ন অর্থায়নের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ,
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উৎপাদক, প্রাকৃতিক
সম্পদ-নির্ভর জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা
নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিম্নোক্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা প্রয়োজন
বলে মনে করি :
২.১ ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার : প্রত্যেক ব্যক্তি এবং জনগোষ্ঠী
সার্বজনীনভাবে অর্জিত অধিকারসমূহ রক্ষা করতে রাষ্ট্র, আঞ্চলিক জোট ও
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দায়বদ্ধ থাকতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা : প্রত্যেক মানুষের জীবন ও জীবিকা
নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত
ভূমি, বন-জঙ্গল, সাধারণ জলাধার, উপকূল ও সমুদ্র সম্পদে প্রবেশাধিকার, যৌথ
মালিকানা ও ব্যবস'ানায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে
হবে;
- মানবাধিকার : মানবাধিকারের উপর প্রস্তাবিত কর্মসূচির নেতিবাচক
প্রভাব নিরূপণ, মূল্যায়ন এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে মানবাধিকারের
উপর প্রভাব বিশ্লেষণ করে কর্মসূচির শ্রেণীকরণ করতে হবে। মানবাধিকারের
প্রচলিত সূচক ব্যবহার ছাড়াও ‘সামাজিক প্রভাব নিরূপণে’ মানবাধিকারের
বিষয়টিকে ভিত্তি হিশেবে গ্রহণ করতে হবে;
- সাংস্কৃতিক পরম্পরা : প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্য, আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট ও লোকজ জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং
প্রথাগত চর্চাসমূহ রক্ষায় সহায়তা করতে হবে।ৎ
২.২ ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ : উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে
কোনোক্রমেই স'ানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, বসতি, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য
হুমকির সম্মূখীন করা যাবে না। এ লক্ষ্যে,
- বাস্তুচ্যুতি : উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি দ্বারা
কোনোক্রমেই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উৎপাদক শ্রেণী, বিশেষত কৃষক, জেলে ও
আদিবাসী জনগোষ্ঠী যেন বাস'চ্যুত না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনো
কারণে বাস'চ্যুতি এড়ানো না যায় তাহলে বাস'চ্যুতদের যথাযথ পুনরাবাসন ও
পুনর্বাসন ব্যবস'া নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু জাতীয় উন্নয়নের খাতিরে
বাস'চ্যুত জনগোষ্ঠী সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করে সেহেতু পুনরাবাসন ও
পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ বলতে শুধুমাত্র আর্থিক ভর্তুকি বোঝাবে না বরং
ক্ষতিগ্রস' পরিবার ও সমাজের জন্য উন্নততর ও যথাযথ জীবিকা, সাংস্কৃতিক ও
লোকজ জ্ঞান চর্চা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা বোঝাবে;
- ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার : কালের বিবর্তনে স্থানীয়
জনগোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য, প্রথাগত ও স্থানিক অধিকার, চর্চা ও অলিখিত
আইনসমূহের স্বীকৃতি দিতে এবং সম্মান প্রদর্শন করতে হবে;
- প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য : স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি করা যাবে না;
- সামাজিক মিথস্ক্রিয়া : কোনো নীতি, উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি বা অর্থায়ন যেন সমাজের মধ্যে বিভেদ, হিংসা বা দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয়া যাবে না।
- ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির সময়সীমা : কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ
হয়ে গেলেই অথবা প্রকল্পের প্রত্যক্ষ ক্ষতির জন্যই ক্ষতিপূরণ নয় বরং
প্রকল্পের সহযোগী ক্ষতি (collateral damage and spill over impact), পরোক্ষ
ক্ষতি (indirect damage) এবং প্রকল্পের মেয়াদ (project life time) শেষ
হবার পরও সংঘটিত ক্ষতির জন্য পর্যাপ্ত এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার
নিশ্চিত করতে হবে।
২.৩ জনগণের সার্বভৌমত্ব : সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- সমাজভিত্তিক উন্নয়নসূচি ও অগ্রাধিকার : সকল প্রকার উন্নয়ন
প্রকল্প ও কর্মসূচিতে স'ানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও অগ্রাধিকারের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত ও অগ্রাধিকারের উপর ভিত্তি
করেই সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং সাধারণ মানুষই থাকবে
উন্নয়নের কেন্দ্রে;
- জাতীয় ও স্থানীয় নীতির সামঞ্জস্য : আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত
নিয়মনীতি ও আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনগণের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত সামাজিক
অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় নীতি প্রণয়ন, সংশোধন ও বাস্তবায়ন
করতে হবে;
- প্রত্যাখ্যানের অধিকার : কোনো উন্নয়ন কর্মসূচির সামাজিক বা
পরিবেশগত প্রভাব ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হলে বাস্তবায়নের যে কোনো পর্যায়ে
স'ানীয় জনগোষ্ঠী যাতে কর্মসূচিটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে তার বিধান রাখতে
হবে;
- সংগঠনের অধিকার : যে কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব
মতামত প্রচার, নিজ মতামতের পক্ষে জনমত গঠন এবং সম্মিলিতভাবে আলোচনা ও দর
কষাকষির জন্য সংগঠিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হবার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২.৪ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা : জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য
স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে জবাবদিহিতা ও
দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে। এ লক্ষ্যে :
- সরকারি ও ব্যক্তিখাতের দায়বদ্ধতা : প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার
সকল স্তরে সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের কার্যকর ও ফলপ্রসূ অংশগ্রহণ
এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা
নিশ্চিত করতে হবে;
- তথ্য অধিকার : কর্মসূচি বিষয়ক তথ্যে সাধারণের প্রবেশাধিকার,
স্বচ্ছ যোগাযোগ কৌশল এবং স্বেচ্ছায় তথ্য উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে জনগণের
তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২.৫ প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা : পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং সাধারণ সম্পদ রক্ষার নীতি অনুসরণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- দুষণকারীর দায়বদ্ধতা : যে কোনো ধরনের দুষণ প্রতিরোধ ও
দুষণকারীকে দায়বদ্ধ করায় জনগণের ন্যায্য অধিকারকে সকল উন্নয়ন কর্মসূচি ও
প্রকল্পের মূলনীতি হিশেবে গ্রহণ করতে হবে। দূষণ অপসারণের ব্যবস্থা,
পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য দুষণের ঝুঁকি সম্পর্কে তথ্য জানার
অধিকারের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনই শিল্প-কারখানা স্থাপনের মূল শর্ত হতে
হবে;
- প্রতিবেশের পুনর্জীবায়ন : উন্নয়ন প্রকল্প বা কর্মসূচির
মাধ্যমে প্রতিবেশের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন হলে উক্ত প্রতিবেশ পূর্বাবস্থায়
ফিরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় ব্যয় বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বহন করত হবে।
- পরিবেশ বীমা : কর্মসূচি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বেই বাস্তবায়নকারী প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশ বীমা থাকতে হবে;
২.৬ নিরাপত্তা : প্রকল্প বা কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন এলাকার জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তা কোনোক্রমেই লঙ্ঘন করা যাবে না। এ লক্ষ্যে
- শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের অধিকার : বেসরকারি বিনিয়োগের
মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন এলাকায়
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ ও অহিংস প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সামরিক,
আধাসামরিক বা পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ বন্ধ করতে হবে;
- ব্যক্তিগত নিরাপত্তা : সামনের সারির আন্দোলনকারী,
মানবাধিকার ও পরিবেশ অধিকার রক্ষার কর্মী এবং জনস্বার্থে তথ্য
উন্মুক্তকারীসহ নিজের বা জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে হবে;
- আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার : যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প
বা কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ আদিবাসী অধিকারের ঘোষণাপত্র
(ইউএনড্রিপ) অনুসারে আদিবাসী এবং ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহের
স্বনিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করতে
হবে।
২.৭ জনগণের ক্ষমতায়ন : যেহেতু জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়নই মূল
লক্ষ্য সেহেতু যে কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্পে সাধারণ জনগণের ক্ষমতায়ন ও
তাদের অংশগ্রহণকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- অংশগ্রহণের অধিকার : যে কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের
ক্ষেত্রে জনগণের কল্যাণকে কেন্দ্রে রেখে, তাদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে
সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এমনভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে যাতে তারা
সন্তুষ্ট হয়;
- স্বাধীন সম্মতিদানের অধিকার : সকল তথ্য জেনে চাপমুক্ত অবস্থায়
প্রকল্প শুরুর আগেই যাতে আদিবাসীসহ সকল জনগোষ্ঠী প্রকল্প বা কর্মসূচি
সম্পর্কে তাদের সম্মতি দিতে পারে সেজন্য প্রকল্প গ্রহণের আগেই
বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর গণশুনানির আয়োজন করতে হবে। এসব শুনানিতে প্রকল্প
প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর থাকবে;
- সামাজিক প্রভাব হ্রাসকরণ : পরিবেশের পাশাপাশি প্রত্যেক
প্রকল্পের সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব মূল্যায়ন করে তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে
রাখার পরিস্কার পরিকল্পনা রাখতে হবে;
২.৮ অন্তর্ভূক্তিকরণ ও বৈষম্যহীনতা : জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার
ও প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি পরিচিতি নির্বিশেষে সমাজের সকলে যেন উন্নয়ন
কর্মসূচি বা প্রকল্পের মাধ্যমে সাম্যের ভিত্তিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক
সুবিধা লাভ করতে পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তি : সকল প্রকল্প, কর্মসূচি,
অর্থায়ন ও নীতিতে বিপদাপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তি ও
বৈষম্যহীনতার বিষয়টি বিশেষভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে;
- নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন : তথ্য উন্মুক্তকরণ, পরামর্শ ও
অংশগ্রহণ, পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নসহ সকল
পর্যায়ে অংশগ্রহণে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২.৯ অর্থায়নের কার্যকারিতা ও দুর্নীতি : প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের সকল পর্যায় থেকে দুর্নীতি দূর করার মধ্য দিয়ে অর্থায়নের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- অর্থায়নকারীদের জবাবদিহিতা : উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচিতে অর্থায়নকারী পক্ষসমূহকে জাতীয় পরিবেশ বিষয়ক আইন ও অন্যান্য রক্ষাকবচ মেনে চলায় বাধ্য করতে হবে।
- দায়মুক্তি : আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের
কর্মসূচি ও প্রকল্পের কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস' হলে তাদের বিরুদ্ধে
আদালতে নালিশ জানানোর অধিকার দিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বিদ্যমান ‘দায়মুক্তি
আইন’ বাতিল করতে হবে এবং ভবিষ্যতে কোনো অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানকে
দায়মুক্তি দেয়া যাবে না;
- দুর্নীতিমুক্ত থাকার অধিকার : উন্নয়ন কর্মসূচি ও প্রকল্প
বাস্তবায়নে যে কোনো ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকার অধিকার সাধারণ মানুষের
রয়েছে। এ অধিকারের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে।
২.১০ আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদ : বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে এমন আন্তর্জাতিক চুক্তি, নীতিমালা, সনদ ও নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের কার্যকারিতা : জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার
সনদ, প্রাণবৈচিত্র্য সনদ, দুর্নীতিবিরোধী সনদ, নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ
সদন, জলবায়ু সনদ ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনসহ মানবাধিকার ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট
আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ, নীতিমালা ও নিদের্শনাসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে
হবে;
- সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধি প্রণয়ন : আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির
পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ মানবাধিকার ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট যেসব আন্তর্জাতিক
সনদ ও চুক্তির অঙ্গীকার পূরণে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, সেগুলো পূরণ করতে হবে;
- শ্রমিক অধিকার : আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর শ্রমিকদের অধিকার সংশ্লিষ্ট সনদসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।
২.১১ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা : বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু
পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে কার্বন-সাশ্রয়ী ও জলবায়ু-সহিষ্ণু
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে,
- জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন : ন্যায্যতা ও উন্নয়নের
সাম্যের মূলনীতি অনুসারে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অভিযোজন ক্ষমতা ও
সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির জন্য সরাসরি পর্যাপ্ত অর্থায়ন, ক্ষতিপূরণ-ব্যবস্থা ও
ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে;
- জলবায়ু-ঋণ : জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্দশা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সকল ধরনের জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট ঋণ বাতিল করতে হবে;
- প্রতিবেশ-দেনা : জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিশেবে বাংলাদেশের অতীত
দেনা বাতিল করা এবং ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে প্রতিবেশ ধ্বংস করার মাধ্যমে
সৃষ্ট দেনা পরিশোধের দাবি জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত
বিশ্বের নিকট তুলে ধরতে হবে।
- ক্ষতিকর প্রকল্প : জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, নোংরা
জ্বালানি ব্যবহার করে কিংবা অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন করে এমন সকল প্রকার
উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
৩. কৌশল (Strategy)
বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে জন-রক্ষাকবচ নিশ্চিত করার জন্য একটি
সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে নিম্নোক্ত কৌশলসমূহ গ্রহণ করা হবে :
৩.১ জোট গঠন : মানবাধিকার, আদিবাসী, নারী অধিকার, পরিবেশ, বাণিজ্য,
প্রাথমিক উৎপাদক (জেলে, কৃষক, কৃষিশ্রমিক, বনজীবী), শ্রমিক (গার্মেন্ট
শ্রমিক, হকার, শিল্পশ্রমিক), নাগরিক সমাজ প্রভৃতি বিষয়ে কর্মরত গোষ্ঠী ও
সংগঠনসমূহের অংশগ্রহণে কর্মজোট গঠন করা।
৩.২ গবেষণা ও অধ্যয়ন : আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ
কর্তৃক বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিনিয়োগের ফলে অর্থনীতি ও সমাজের উপর
ক্ষতিকর প্রভাব, জন-রক্ষাকবচ বিষয়ক জাতীয় আইন ও নীতিমালা লঙ্ঘন ও
জনসাধারণের দুর্ভোগ বিষয়ক ত্বরিৎ গবেষণা, আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী
প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক রক্ষাকবচের তুলনামূলক
বিশ্লেষণ, প্রকল্পভিত্তিক সামাজিক-পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ ইত্যাদি।
৩.৩ অধিপরামর্শ : স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি (ইউনিয়ন,
উপজেলা ও জেলা পরিষদ), সংসদ সদস্য, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সংসদ
সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা, সংলাপ,
অনানুষ্ঠানিক বৈঠক, সেমিনার, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা।
৩.৪ গণমাধ্যম : সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের অংশগ্রহণে
ওরিয়েন্টেশন, প্রশিক্ষণ, সংবাদ সম্মেলন, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, ক্ষতিগ্রস'
এলাকায় সাংবাদিকদের সফর, টেলিভিশন টক শোতে অংশগ্রহণ এবং উপ-সম্পাদকীয় ও
নিবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ সাইট
(ফেসবুক, টুইটার, আভাজ ইত্যাদি) ব্যবহার করে নতুন অনলাইন মিডিয়াসমূহে
প্রচার চালানো।
৩.৫ প্রচারাভিযান : জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও মতামত গ্রহণের উদ্দেশ্যে
ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণের সঙ্গে আলোচনা, গণ শুনানি, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে
সংলাপ, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি, সমাবেশ, মানব-বন্ধন, অভিনব কর্মসূচি
ইত্যাদি পালন করা।
৩.৬ সক্ষমতা বৃদ্ধি : অংশগ্রহণকারী ও সহযোগী সংগঠনসমূহের দক্ষতা ও
সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার ও
পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, ওরিয়েন্টেশন, আলোচনা সভা ও
সম্মেলন আয়োজন করা।
৪. কাজের ক্ষেত্র (Scope of Engagement)
৪.১ স্থানীয় পর্যায় : ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠী, আন্দোলনকারী সংগঠনসমূহ,
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি (ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ), সংসদ
সদস্য, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিবর্গ, নাগরিক সমাজ, স্থানীয়
সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, উপজেলা ও জেলা প্রশাসন, সমমনা এনজিও এবং
সাংস্কৃতিক সংগঠন।
৪.২ জাতীয় পর্যায় : সংসদ সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, মন্ত্রণালয়,
প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ, জাতীয় সংবাদপত্র ও
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সমমনা এনজিও, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক প্রতিনিধি ও
আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ।
৪.৩ আঞ্চলিক পর্যায় : সমমনা আঞ্চলিক সংগঠন ও নাগরিক জোটসমূহ,
আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (সার্ক, সাসেক, বিমসটেক) এবং আঞ্চলিক আলোচনাসমূহে
জাতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ।
৪.৪ বৈশ্বিক পর্যায় : সমমনা বৈশ্বিক জোটসমূহ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, বহুপাক্ষিক সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি এবং
বহুপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী জাতীয় প্রতিনিধিবৃন্দ।
৫. দাবিসমূহ (Demands)
- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)সহ সকল আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের দায়মুক্তি বাতিল করো;
- জাতীয় পুনরাবাসন ও পুনর্বাসন (Resettlement and Rehabilitation) নীতি গ্রহণ করো;
- অনৈতিক, বেআইনি ও ক্ষতিকর ঋণ বাতিল করো;
- জাতীয় জন-রক্ষাকবচ (National Safeguard Policy) নীতিমালা গ্রহণ করো;
- কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করো;
- উন্নত বিশ্বের নিকট থেকে প্রতিবেশ-দেনা আদায় করো;
- আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের চাপে তৈরি উদারীকরণ নীতি বাতিল করো;
- জলবায়ু-ঝুঁকি মোকাবেলায় ঋণগ্রহণ বন্ধ করো।
বৈদেশিক ঋণ বিষয়ক বাংলাদেশ কর্মদল (BWGED) সদস্যবৃন্দ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬; ঢাকা, বাংলাদেশ